ফুটবল রাজ্যে নিজের রাজত্ব দেখিয়েছেন পর্তুগালের সেনশেসন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পায়ের জাদুতে বিমোহিত করেছেন অসংখ্য ভক্তদের। রোনালদোর পরিশ্রম, উঠে আসার গল্প প্রভাবিত করেছে অনেক তরুণকে। পর্তুগাল থেকে ৯০৪৭ কিলোমিটার দূরের দেশ বাংলাদেশে এক কিশোর ফুটবলারকেও প্রভাবিত করেছেন তিনি, যাকে ঘিরেই এখন স্বপ্ন দেখে লাল-সবুজদের সমর্থকরা। নাম তার শেখ মোরসালিন।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে ডি বক্সের অনেক বাইরে থেকে একটি আগুনে শটে গোল করে প্রথমবার আলোচনায় আসেন মোরসালিন। তখন বসুন্ধরা কিংস থেকে লোনে ঢাকা মোহামেডানে খেলতে গিয়েছিলেন তিনি। ফেসবুকে ভাইরাল হয় ভিডিওটি, এক কিশোরকে নিয়ে আশার বুকটা হয়তো তখনই বাঁধতে শুরু করে বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তরা।
ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলায় ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন মোরসালিন। নিজ স্কুলের পক্ষে সর্বপ্রথম ফুটবল খেলতে মাঠে নামেন তিনি। এরপর কয়েক দফা বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে ট্রায়ালের পর ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হন। বিকেএসপি’র হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহনের পর ২০১৯-২০ ঢাকা তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগের দল আলমগীর সমাজ কল্যান কেএস এর হয়ে নিবন্ধিত হন মোরসালিন। সেখান থেকেই শুরু হয় তার স্বপ্ন যাত্রা। লিগে ১৬ ম্যাচে ১৮ গোল দিয়ে হয়ে যান সর্বোচ্চ গোলদাতা।
মোরসালিনের পারফর্ম্যান্স নজর এড়ায়নি দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের। তাই দ্রুত তাকে দলে ভিড়িয়ে নেয় কিংস। কিন্তু দেশের এতো এতো তারকা ফুটবলারের ভিড়ে এই ১৭ না পেরোনো কিশোর নিজেকে প্রমানের সুযোগই পাওয়ার কথা না। কিংস ম্যানেজমেন্টও বুঝতে পারেন মোরসালিনকে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। তাই ২০২১-২২ মৌসুমের মধ্যবর্তী দলবদলে লোনে ঢাকা মোহামেডানে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালোদের হয়ে ২২ জুন, ২০২২ এ অভিষেক হয় মোরসালিনের। লিগে দলে হয়ে শেখ জামালের বিপক্ষে সর্বপ্রথম গোল করেন তিনি। এরপরই ঘটে কিংসের বিপক্ষে সেই নজরকাড়া গোলের ঘটনা। ২০২২-২৩ মৌসুমে লোন শেষে ফিরে আসেন বসুন্ধরা কিংসে। স্বাধীনতা কাপে শেখ রাসেলের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে কিংসের হয় অভিষেক হয় এই তরুণ খেলোয়াড়ের। এরপর নিয়মিতই দলের হয়ে পারফর্ম করেছেন মোরসালিন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ ২০২৩ এর জন্য সর্বপ্রথম বাংলাদেশ দলে ডাক পান শেখ মোরসালিন। যদিও প্রাথমিক দলে তিনি ছিলেন না, কিন্তু দলে থাকা সাদ উদ্দিন ও মতিন মিয়ার চোট সুযোগ এনে দেয় এই তরুণ খেলোয়াড়কে। ফিফা প্রীতি ম্যাচে ১৫ জুন, ২০২৩ এ কম্বোডিয়ার বিপক্ষে ৭০ মিনিটে বদলি নেমে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক হয় তার। সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের পারফর্ম্যান্সে আবারও মোরসালিন দেশবাসীকে জানান দেন তিনি কোন সাধারণ খেলোয়াড় নন, এসেছেন বড় কিছুই করতে। মালদ্বীপের বিপক্ষে আবারো নিজের ট্রেডমার্ক দূরপাল্লার জোড়ালো শটে বল জালে জড়িয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে যান টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে।
সাফের সেমিফাইনালে কুয়েতের বিপক্ষে একটি সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন মোরসালিন। মিসের ধারা যেন অব্যাহত থাকে কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের সাথে হয়ে যাওয়া দুই আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের প্রথমটিতেও। তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগে উঠে, ‘তারকা আখ্যা দিতে বেশি তাড়াহুড়ো হলো না তো?’। কিন্তু পরের ম্যাচেই গোল করে মোরসালিন আশ্বস্ত করলেন সবাইকে, তিনি ক্ষণস্থায়ী নন, এসেছেন সবার মনে চিরস্থায়ী হতে।
শুরুর মতো শেষেও বলতে হয়, প্রিয় জার্সি নম্বর ৭ নিয়ে, নিজের আইডল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতোই বার বার গোল সেলিব্রেশনে দেশকে মাতাতেই এসেছেন তিনি। নাম তার শেখ মোরসালিন!