‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই ‘ – উক্ত বাক্যকে যর্থার্থ মর্যাদা দিয়ে গেছেন পৃথিবীর অসংখ্য গুনী ব্যক্তি। বাংলাদেশের ফুটবলেও একজন ব্যক্তি উক্ত বাক্যের মর্মার্থ বুঝিয়ে গিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ‘কিং ব্যাক’ মোনেম মুন্না। মৃত্যুর পরও যখন মানুষের হৃদয়ে, কথার আড্ডায়, স্মৃতিচারনে একজন থেকে যায়; তখনই তো সে অমর হয়। নিজেকে ফুটবলীয় কীর্তিতে অমর করে গিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা মোনেম মুন্না।

শুরুতেই দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা বলাতে অনেকে হয়তো দ্বিতীয়বার ভাবছেন! বড় তারকা সোশাল মিডিয়ায় লাইক-ফলো বা সুদর্শন খেলোয়াড় হিসেবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এম্বাসেডর হিসেবে বলিনি। অবশ্য মোনেম মুন্নার ছবি দেখলেই বুঝবেন তিনি কোন অংশে ঐ এম্বাসেডরদের চেয়ে কম সুদর্শন ছিলেন না। সোশাল মিডিয়ার যুগ তার সময়ে থাকলে হয়তো লাইক-ফলোয়ারেরও অভাব হতো না। বড় তারকা বলার পিছে হয়তো বাংলাদেশের এক সাবেক কোচের উক্তিটা দিলে কারণ বুঝে যেতে পারেন। বাংলাদেশের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন,‘He was mistakenly born in Bangladesh.’ তার এই মন্তব্যটি ছিলো বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তি খেলোয়াড় মোনেম মুন্নাকে নিয়ে। ফিস্টার সহ আরো অনেকে মনে করতেন দেশের বাইরে যদি খেলার সুযোগ পেতেন হয়তো আরো অনেক উপরের পর্যায়ে যেতে পারতেন তিনি। তবে তিনি সেটার প্রমানও রেখেছেন। উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব ভারতের ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে খেলে কলকাতার মানুষের মন জয় করা ছোট কোনো কথা নয়।

সত্তর-আশির দশকের সময় দেশের ফুটবলে ছিলো তুমুল উত্তেজনা। বিশেষ করে ঢাকা আবাহনী এবং ঢাকা মোহামেডানের খেলা নিয়ে। একটা সময় দেশ দুইটি ভাগে বিভক্ত হতো শুধু আবাহনী- মোহামেডান নিয়ে। সেই সময়কার তারকা ফুটবলার ছিলেন মোনেম মুন্না। আসলাম, চুন্নু, কায়সার হামিদ সহ এত এত তারকার মাঝেও একজন ডিফেন্ডার হয়ে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই আজও দেশের ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার মনে করা হয় মোনেম মুন্নাকে।

১৯৬৮ সালের ৯ জুন নারায়নগঞ্জে জম্মগ্রহন করেন মোনেম মুন্না। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন তিনি। মোনেম মুন্না প্রথম নজরে আসেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের বিরুদ্ধে নারায়নগঞ্জের হয়ে একটি প্রীতি ম্যাচে। তখন তার বয়স ছিলো ১৪ বছর। হঠাৎই এতো বড় ম্যাচে তাকে মাঠে নামিয়ে দেন নারায়নগঞ্জের কোচ। তা দেখে বাফুফের কর্তা সহ সকলেই অবাক। জাতীয় দলের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের বাচ্চা কিইবা খেলবে তেমন। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে সেদিন প্রমান করেছিলেন তিনি এবং বার্তা দিয়েছিলেন তিনি আসছেন।

১৯৮০-৮১ মৌসুমে ১২ বছর বয়সে পাইওলিয়ার লীগের দল গুলশান ক্লাবে নাম লেখান এই তারকা। পাইওলিয়ারে মূলত ১৪-১৫ বছরের ছেলেরা খেললেও সেখানে মাত্র ১২ বছর বয়সেই নিজের খেলা দিয়ে নজরে আসে মুন্না। এরপরের মৌসুমে যোগ দেন শান্তিনগরে। সেখান থেকে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা এসকেসি’তে। তখন মুক্তিযোদ্ধা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে। ১৯৮৩ সালে মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে প্রথম বিভাগে পদচারণা হয় মোনেম মুন্নার। প্রথম বিভাগেও নিজের নৈপুন্য ধরে রাখতে সক্ষম হন তিনি। এরপর দল বদলে ১৯৮৬ সালে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ব্রাদার্সে তার দুরন্ত খেলা নজরে আসে আবাহনী কর্তাদের। তখন আবাহনীতে দেশের সব তারকা ফুটবলাররা রয়েছে। আশরাফ উদ্দিন চুন্ন, গোলাম রাব্বানী হেলাল, আসলামের মত তারকারা তখন দেশের ফুটবলে রাজত্ব করছিলেন সাথে আবাহনীও। ১৯৮৭ সালে মোনেম মুন্নাকে আকাশী নীল জার্সিতে নিয়ে আসেন আবাহনীর কর্তারা। তখন মুন্নার বয়স ১৯ বছর। আবাহনীতে নিজেকে আরো পরিণত করেন এই তারকা ফুটবলার। আবাহনীকেই বানিয়ে নেন নিজের ঘর হিসেবে। ক্যারিয়ারের শেষ পযর্ন্ত ছিলেন দেশ সেরা এই ক্লাবটিতে।

১৯৯১ সালে তিনি সুযোগ পান উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে খেলার। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে লীগ ও ফেডারেশন কাপ জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে মোনেম মুন্না। তার খেলায় কলকাতার দর্শক এবং ইস্টবেঙ্গলের কর্তারা অনেক অবাকই হয়েছিলো। তাকে দেখে কর্তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো মোনেম মুন্নার মত দ্বিতীয় কেউ এই উপমহাদেশে আর জম্ম নিবে না। নিজের সেরা খেলা দেখিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ‘হল অব ফেম’ এ জায়গা করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়। মাত্র দুই মৌসুমেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এসেছিলেন কলকাতার মাঠে। ১৯৯১ সালে রের্কড পরিমান অর্থ পেয়েছিলেন মোনেম মুন্না। তখনকার সময়ের ২০ লক্ষ টাকায় ঢাকা আবাহনী স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি, যা তখন অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। এই রের্কড পরিমাণ অর্থে বিষয়ে চারদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। একজন ডিফেন্ডার হয়েও এতো টাকায় দলভুক্ত হওয়া অনেককেই অবাক করে। মুন্না তখন দেশের ফুটবলে ব্র্যান্ডে পরিনত হয়৷ ১৯৯০ দশকে লাইফবয়ের বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন মুন্না। জনপ্রিয় ইউনিলিভার কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্ব্যাসেডর হয়েছিলেন তিনি।

জাতীয় দলেও নিজের সেরা নৈপুণ্য দেখিয়ে গিয়েছেন মোনেম মুন্না। ১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে প্রথম জাতীয় দলে ডাক পান মুন্না। তখন মাত্র ১৮ বছর বয়সের যুবক মোনেম মুন্না। এরপর ইনজুরি ছাড়া নিজের খেলার জন্য কখনই দলের বাইরে থাকতে হয়নি তাকে৷ ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল দীর্ঘ ১১ বছর জাতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন তিনি৷ ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথম জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান মোনেম মুন্না। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের চার জাতীয় টুর্নামেন্টে মোনেম মুন্নার নেত্বতৃে অংশ নেয় টাইগাররা। তখন বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন জার্মান অটো ফিস্টার। সেবারই দেশের ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা আসে। পুরো দলই অসাধারন ফুটবল খেলেছিলো সেই টুর্নামেন্টে, তবে মুন্না খেলা ও নেতৃত্ব আলাদাভাবে সকলের নজরে আসে। ১৯৯৭ সালে নিজের বুট জোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এই ফুটবলার।

ফুটবল খেলা ছাড়লেও ফুটবলকে ছেড়ে থাকতে পারেননি তিনি। তাই তো খেলা শেষে দায়িত্ব নেন নিজের প্রিয় ক্লাব আবাহনী ম্যানেজার পদের। ১৯৯৯ সালে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে ভারতে তার বোন শামসুর নাহার আইভির কিডনি তার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০০৪ সালে আবার তার শরীরে ভাইরাস দেখা দেয়। ২০০৫ সালে ১৭ দিন মৃত্যু সাথে লড়াই করার পর ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন৷ বাংলাদেশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত নিজের প্রানপ্রিয় ক্লাব আবাহনীর ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। পরিশ্রম ও আত্মপ্রত্যয়ী ফুটবলার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন মোনেম মুন্না। নেতৃত্ব এবং পেশাদারি মনোভাবের এক জলন্ত উদাহরন ছিলেন তিনি এবং পরিণত হয়েছিলেন উপমহাদেশে একজন আইকনে। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যা আসলে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। তার স্মরনে ধানমন্ডি ৮ নম্বরের সেতুটিকে ‘মোনেম মুন্না সেতু’ নামকরন করা হয়।

দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, দেশের সবচেয়ে বড় তারকা ফুটবলার, দেশের ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার এবং আমাদের মোনেম মুন্নাকে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে স্মরন করছি। 

Previous articleস্পন্সর চূড়ান্ত না হওয়ায় পিছিয়ে গেল সুপার কাপ!
Next articleবরখাস্ত চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ টিটু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here