২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে পেশাদার ফুটবল লিগের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এত দিন পরও আসলে পেশাদারির ছাপ ওই অর্থে পড়েনি দেশের ফুটবলে। মৌসুমের সময়সীমা, ক্লাবের সংখ্যা বা দলবদলের কোনো নির্দিষ্ট সূচির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগেও সেই ম্যাচ পিছিয়ে দেওয়ার উদাহরণ কম নেই। সব মিলিয়ে পেশাদার ফুটবল লিগ আসলে শুধু নামেই, ক্লাবগুলোও চলছে নিজেদের মর্জিমতোই। একটি পেশাদার ফুটবল দলের নিজস্ব মাঠ থাকা, অন্তত দুটি যুব দল থাকা, নিজস্ব ফিজিও ও চিকিৎসক, পেশাদার ম্যানেজার, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, আইন কর্মকর্তা থাকা এবং বার্ষিক বাজেট ও অডিটের মতো বিষয়গুলো থাকা একবারে আবশ্যকীয়।

তবে বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর এসব ব্যাপার শুধু কাগজে কলমেই বিদ্যমান।একটি ক্লাবের নিজস্ব স্টেডিয়াম তো বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে দিবা স্বপ্নের মতো ছিলো। ‘হোম অফ ফুটবল’ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামই ছিলো ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে একমাত্র অবলম্বন। মাঝে বিচ্ছিন্ন ভাবে ঢাকার বাইরে কিছু ম্যাচ আয়োজিত হলেও দেশের ফুটবল মূলত ঢাকা কেন্দ্রিকই ছিলো। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় স্টেডিয়াম গুলো নিজেদের হোম ভেন্যু হিসেবে ব্যাবহার করলেও বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর ছিলনা নিজস্ব কোনো স্টেডিয়াম। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের অন্যতম সফল ক্লাব ঐতিহ্যবাহী ঢাকা আবাহনী লিমিটেড অবশ্য বছর তিনেক আগে ঘোষণা দিয়েছিল পূর্ণাঙ্গ স্পোর্টস কমপ্লেক্স করার। তবে তাদের ঘোষণা ঘোষণাই রয়ে গেছে, দেখেনি আলোর মুখ। তবে প্রথম বাংলাদেশী ক্লাব হিসেবে নিজেদের হোম ভেন্যুর অভাব ঘুচিয়েছে বসুন্ধরা কিংস।

২০১৮-১৯ মৌসুমে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে উত্তীর্ণ হয় বসুন্ধরা কিংস। বাংলাদেশের ফুটবলে আগমনের পর থেকেই সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে কিংস। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আসার পর থেকেই ক্লাব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাজায় কিংস ম্যানেজমেন্ট। মাঠের খেলায় ভালো ফলাফল করতে দেশীয় সেরা ফুটবলারদের সাথে ভালো মানের বিদেশি ফুটবলার ও কোচদের নিয়ে এখন পর্যন্ত সফলই বলা যায় বসুন্ধরা কিংসকে। সেই সাথে মাঠের বাইরের প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পন্ন করে একটি পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ক্লাব হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর ছিলো বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন দলটি। সেই লক্ষ্যে ২০১৯ সালের জুনে ২০০ বিঘা জমি নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘এন’ ব্লকে গড়ে উঠতে শুরু করে এক অত্যাধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স। ফুটবল স্টেডিয়ামের পাশাপাশি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, হকি স্টেডিয়াম, ভলিবল ও কাবাডি কোর্ট, ফুটসাল গ্রাউন্ড, বাস্কেটবল করতে, গলফ ও ড্রাইভিং রেঞ্জ, শুটিং ও আর্চারি রেঞ্জ এবং সুইমিংপুলের মতো ইভেন্টের ব্যবস্থা রেখে এগিয়ে চলছে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ। এই কমপ্লেক্সটি বিভক্ত দুটি জোনে। নর্থ জোনে রয়েছে এএফসির শর্ত মেনে ১০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার গ্যালারিসহ ফুটবল স্টেডিয়াম। আর সাউথ জোনে তৈরি হচ্ছে ক্রিকেট মাঠ। এর মধ্যেই ফুটবল মাঠের কাজ প্রায় শেষের দিকে। গ্রাউন্ডের কাজ শেষ হয়েছে আগেই, এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আর কিছু অবকাঠামোগত কাজ বাকি থাকলেও লিগ শুরু হওয়ার আগেই সেগুলো সম্পন্ন করে ম্যাচ আয়োজনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে বসুন্ধরা কিংসের হোম ভেন্যু।

নিজেদের হোম ভেন্যুতে ম্যাচ আয়োজনের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো ক্লাব প্রথমবারের মতো নিজেদের মালিকানাধীন মাঠে আয়োজন করতে যাচ্ছে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ম্যাচ। প্রতিবেশী ভারতের ক্লাবগুলো এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও এখনো নিজস্ব স্টেডিয়াম গড়ে তুলতে পারেনি। ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী ক্লাব হিসেবে ধরা হয় জেএসডব্লিউ গ্রুপের মালিকানাধীন বেঙ্গালুরু এফসিকে। এএফসি কাপে দুবার আন্ত–আঞ্চলিক ফাইনাল খেলা দলটিরও নেই নিজস্ব স্টেডিয়াম। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় লিগ ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি আইএসএল। সেখানে খেলা দলগুলো আধুনিক ফুটবলের অনেক বিষয়ে এগিয়ে গেলেও এখনো নিজেদের স্টেডিয়াম তৈরি করতে পারেনি। আইএসএলের ক্লাবগুলো হোম ভেন্যু নির্বাচন করছে বিভিন্ন প্রদেশের স্টেডিয়ামগুলো লিজ নিয়ে। সে হিসেবে বাংলাদেশের নতুন দল হয়ে বড় একটি মাইলফলকই স্পর্শ করতে যাচ্ছে বসুন্ধরা কিংস।

আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাওয়া লিগের জন্য চূড়ান্ত হওয়া বাকি ছয় ভেন্যু হলো টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়াম, কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম, মুন্সিগঞ্জের বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়াম, গোপালগঞ্জের শেখ মনি স্টেডিয়াম, রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়াম ও সিলেট জেলা স্টেডিয়াম। এর মধ্যে আবাহনী লিমিটেড খেলবে সিলেটে, কুমিল্লায় মোহামেডান ও চট্টগ্রাম আবাহনী, শেখ জামাল ধানমন্ডি ও সাইফ স্পোর্টিং মুন্সিগঞ্জে, গোপালগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাব রাজশাহীতে, টঙ্গীতে উত্তর বারিধারা ও রহমতগঞ্জ। বাকি ক্লাবগুলো কে কোন ভেন্যুতে খেলবে, তা চূড়ান্ত হবে ২৫ জানুয়ারি। উল্লেখ্য, সংস্কার কাজ চলায় এবারের মৌসুমে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে কোনো ম্যাচই অনুষ্ঠিত হবে না।

Previous articleতারকাবহুল দল নিয়েও কেন সাফল্য পাচ্ছে না শেখ রাসেল?
Next articleর‍্যাংকিংয়ে উন্নতি লক্ষ্য বানালেন ক্যাবররা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here