নিজেদের ঐতিহ্যেকে প্রায় দীর্ঘ এক দশক পর পুনঃজীবত করলো মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। প্রায় এক যুগ পর বাংলাদেশের ফুটবলে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ফাইনাল। জমে উঠল লড়াই। একের পর এক গোলের রোমাঞ্চ, উত্তাপে মেজাজ হারানো, ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানোর টানাপোড়েন, হারানো সেই আমেজ, নখ কামড়ানো উন্মাদনা সবই ফিরল একযোগে। এমন পারদ চড়ানো ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের শিরোপা উৎসবে মেতে উঠল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এই জয়ে এক ঢিলে মোহামেডান শিকার করলো দুই পাখি। একদিকে যেমন ‘ঢাকা ডার্বি’-তে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী লিমিটেডকে নিজেদের এতোদিনের হারের প্রতিশোধ নিলো,পাশাপাশি দীর্ঘ ন’বছর অপেক্ষার পর শিরোপার খরা ঘুচলো।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ম্যাচের শুরু থেকে গোছানো ফুটবল খেলার চেষ্টা করে আবাহনী। অপরদিকে কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল খেলার পরিকল্পনায় মাঠে নামে মোহামেডান। তবে নিজেদের পরিকল্পনায় অটল থেকে সাদা-কালোদের উপর ছড়ি ঘুরাতে থাকে আকাশী-নীলরা। তারই ধারাবাহিকতায় ম্যাচের ১৭তম মিনিটে এমেকা উগবুগের পাস থেকে বা পায়ের জোরালো শটে বল জালে জড়িয়ে আবাহনীকে এগিয়ে দেন ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। এরপর ৪৩তম মিনিটে দ্বিগুণ হয় ব্যবধান। মাঝমাঠ থেকে মোহাম্মদ হৃদয়ের লং পাস নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কলিন্দ্রেসকে আটকাতে পারেননি মোহমেডানের ডিফেন্ডার হাসান মুরাদ। ডান পায়ের দারুণ শটে সুজনকে পরাস্ত করেন কোস্টারিকান ফরোয়ার্ড। এছাড়াও প্রথমার্ধে আরো বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ তৈরি করে আবাহনী। তবে মোহামেডান ততোটা খোলস ছেড়ে বেরোতে পারেনি। ফলে ২ গোলের লিড নিয়ে বিরতিতে যায় আবাহনী।
তবে বিরতির পর পুরোপুরি বদলে যায় মোহামেডান। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দুই উইংয়ে জাফর ইকবাল ও শাহরিয়ার ইমনকে মাঠে নামান মোহামেডান কোচ আলফাজ আহমেদ। দুই ফ্রেশ লেগ মাঠে নেমেই মোহামেডানের আক্রমনের ধার বাড়ান। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মোহামেডানও দ্বিতীয়ার্ধে জেগে ওঠে আড়মোড় ভেঙে। প্রথমার্ধে ছায়া হয়ে থাকা আক্রমণভাগের মূল সেনানী সুলেমানে দিয়াবাতে ফেরেন চেনা বিধ্বংসী রূপে। মোহামেডানও চার মিনিটের মধ্যে দুই গোলে জমিয়ে তোলে ঐতিহ্যবাহী ডার্বি। ৫৬তম মিনিটে মাঝমাঠ থেকে কামরুলের লং পাসে উড়ে আসা বল আলমগীর ক্লিয়ার করতে পারেননি। বরং তার হেডে বল চলে যায় দিয়াবাতের পায়ে। দারুণ ভলিতে ব্যবধান কমান মোহামেডান অধিনায়ক। এরপর ৬০তম মিনিটে দিয়াবাতের হেডেই সমতা ফিরে ম্যাচে। মুজাফ্ফর মুজাফ্ফারভের জোরাল দূরপাল্লার শট শহীদুল আলম সোহেল আটকানোর পর বল পেয়ে যান বাঁ দিকে থাকা জাফর ইকবাল। তার আড়াআড়ি ক্রসে হেডে লক্ষ্যভেদ করেন দিয়াবাতে।
দ্বিতীয়ার্ধে জমে ওঠা ম্যাচে রঙ বদলাতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। পোস্টের বাঁধায় গোল বঞ্চিত হওয়ার একটু পরই এমেকা উগবুগের অপেক্ষা ফুরোয়। ৬৬তম মিনিটে ফাহিমের শট মোহামেডান গোলরক্ষক হোসেন সুজন ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে আলতো টোকায় লক্ষ্যভেদ করেন এই নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড। ফের এগিয়ে যায় আবাহনী। পুনরায় জেঁকে বসা শঙ্কার মেঘ ৮৩তম মিনিটে আবারও সরিয়ে দেন অধিনায়ক দিয়াবাতে। কামরুলের কর্নারে তার হেড দূরের পোস্ট দিয়ে লুটোপুটি খায় জালে। গোলরক্ষক শহীদুলের কিছুই করার ছিল না। ৩-৩ গোলের সমতায় ফেরা ম্যাচ সেখানেই শেষ হয়ে যেত পারতো। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে রাফায়েলের শট বদলি রাজীবের পায়ে লেগে ক্রসবারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই রাফায়েলের শট কর্নারের বিনিময়ে আটকান সুজন। এরপর কর্নারে বাবলুর হেড ফিরিয়ে মোহামেডানের ত্রাতা এই গোলরক্ষক। ১০৫তম মিনিটে বক্সে ওয়ান-অন-ওয়ান পজিশনে দিয়াবাতেকে ফাউল করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না শহীদুলের। রেফারিও বাজান পেনাল্টির বাঁশি। মোহামেডানকে নিখুঁত পেনাল্টিতে এগিয়ে নেন এই ফরোয়ার্ড। চলতি আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা এ নিয়ে জালের দেখা পেলেন অষ্টমবার। ১১১তম মিনিটে বক্সের অনেক বাইরে থেকে রয়েলের ভলি লাফিয়ে ক্লিয়ার করতে গিয়ে ব্যাথা পান সুজন। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন ম্যাচ জুড়ে মোহামেডানকে দারুণ বিশ্বস্ততায় আগলে রাখা এই গোলরক্ষক। বদলি নামেন আহসান হাবিব বিপু। মাথায় ব্যথা পেলেও মাঠ ছাড়েননি রহমত মিয়া। ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলা চালিয়ে যান এই ডিফেন্ডার। ১১৭তম মিনিটে নিবেদনের প্রতিদানও পেয়ে যান তিনি। দুর্দান্ত শটে বিপুকে পরাস্ত করেন। প্রাণ ফিরে পায় আবাহনীর শিরোপা স্বপ্নও। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে প্রথম শটে গোল করেন মোহামেডানের সুলেমানে দিয়াবাতে। কিন্তু আবাহনীর হয়ে প্রথম শট মিস করেন রাফায়েল অগাস্তো। তার শট ঠেকিয়ে দেন বিপু। দ্বিতীয় শটে মোহামেডানের আলমগীর কবির রানা এবং আবাহনীর এমেকা উগবুগ সফলভাবে বল জালে জড়ান। এরপর তৃতীয় শটে মোহামেডানের রজার দুয়ার্তে এবং আবাহনীর ইউসুফ মোহাম্মদ জালের দেখা পান। তবে চতুর্থ শটে এসে মোহামেডানের শাহরিয়ার ইমনকে আটকে দেন শহীদুল আলম সোহেল। পরের শটে আবাহনীর দানিয়েল কলিন্দ্রেসকেও আটকে দেন বিপু। এরপর পঞ্চম ও শেষ শটে বল জালে জড়িয়ে মোহামেডানকে শিরোপা উল্লাসে মাতান কামরুল ইসলাম। শেষ পর্যন্ত ৮ গোলের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে ১৪ বছর পর মোহামেডানের শিরোপা জয়ের মাধ্যমে। অপরদিকে মৌসুমে ট্রেবল জয়ের স্বপ্ন দেখা আবাহনী থাকলো ট্রফিশুন্য।