সরোয়ার জাহান সজিব : এবারের এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েছিলো বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব ২৩ ফুটবল দল। নামে ভারে এগিয়ে থাকা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তেমন সুখকর কোনো স্মৃতি তৈরি করতে পারে নি, পায় নি কোনো জয়, তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর কারো বিপক্ষে নেই একটি গোল, বরং দুর্ভাগ্যের বেড়াজালে আটকা পড়ে বাদ পড়তে হয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে। তবে এতসব অপ্রাপ্তির মাঝেও রয়েছে ক্ষুদ্র এক প্রাপ্তির দেখা, দেশের ফুটবল পেতে যাচ্ছে গোলবারের নতুন এক অতন্দ্র প্রহরীকে। যার রয়েছে তেজ, রয়েছে হার না মানা মনোবল, যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে নাড়িয়ে দিতে পারে প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাসের  ভিত। নাম তার মিতুল মারমা। অনেকদিন যাবত মিতুল মারমা জাতীয় দলের রাডারে থাকলেও বর্তমানে জিকোর অনুপস্থিতিতে যে তিনি সবচেয়ে বড় আশার প্রদীপ হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মিতুল মারমার জন্ম ২০০৩ সালের ১১ ই ডিসেম্বর। পারিবারিক পেশা কৃষি হলেও কৃষি মিতুলকে টানে নি, মিতুলের আকর্ষণ ছিলো চামড়ার গোলাকার ফুটবলে। পাহাড়ি জনপদের মতো ফুটবলে মিতুলের জীবণরেখাটাও ছিলো দুর্গম। মিতুল মারমার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা জন্মে ২০১০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। অন্য সবার মতো তিনিও নিজেকে আফ্রিকা ফুটবল বিশ্বকাপের জোয়ারে ভাসিয়েছেন। “আমার বেড়ে উঠার সময়টাতে আফ্রিকা ফুটবল বিশ্বকাপ আসে। তখন দেখতাম যে ফুটবলটাকে সবাই খুব উপভোগ করতেছে। সেটি আমাকেও আকৃষ্ট করে। তখন থেকে বন্ধুদের সাথে একটু আধটু করে আমার ফুটবল খেলা শুরু। আস্তে আস্তে করে ফুটবলের প্রতি ভালোলাগাটা তৈরি হয়” – এভাবেই ফুটবলের প্রতি নিজ ভালোবাসা শুরুর কথাটি জানান মিতুল।

তিনি ফুটবলে গোলবার সামলানোর দায়িত্বটা পালন করেন। প্রদীপের আলো তুলনামূলকভাবে কম পড়ে যে পজিশনে সেই পজিশনটাকে বেছে নিয়েছেন মিতুল। তবে শুরুতে তিনি গোলকিপার ছিলেন না, “ছোটবেলা থেকে প্রোফেশনাল গোলকিপার যাকে বলে সেটা আমি ছিলাম না। তবে মাঝেমধ্যে আমার গোলকিপারের পজিশনে খেলা হতো, আবার উপরেও খেলতাম। আমরা জানি যে গ্রামগঞ্জে খেলায় কিন্তু সচারাচর নির্দিষ্ট কোনো পজিশন থাকে না। একেকজনকে একেক সময় একেক পজিশনে খেলতে হয়। তো গোলকিপার খেলতাম, ভালো খেলতাম। ওই থেকে আরকি গোলকিপার হওয়া।”

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক শান্তজিৎ তনচংগ্যার হাত ধরে তার ফুটবলে হাতেখড়ি। শুরুটা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল ফুটবলে নিজের জেলা রাঙ্গামাটিকে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। প্রকৃতির একটি চিরন্তনরূপ হলো খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়ী জীবণে প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে। কিন্তু মিতুল মারমার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি, বরং ঘটেছে উল্টোটা। পরিবারের শুরু থেকেই সাপোর্ট পেয়ে এসেছেন, “আমার পরিবার আমাকে শুরু থেকে সাপোর্ট করে এসেছে। আমাকে কোনো চাপে রাখতো না। আপনারা জানেন আমাদের পারিবারিক পেশা কৃষি। ফুটবলার হওয়ার শুরুর সময়টাতে পরিবারকে কৃষিকাজে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করতাম, আবার সময়মতো নিজের খেলাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। উনারাও আমাকে কিছু বলতেন না,বরং আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট করতেন।”

২০১৫ সালে পাইওনিয়ার লীগে নোয়াখালী ফুটবল একাডেমির হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে পা দেন মিতুল মারমা। ২০২০ সালে উত্তর বারিধারার হয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে যাত্রা শুরু হয়। সে বছরের ২৩ অক্টোবর ফেডারেশন কাপে সাইফ স্পোর্টস ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচের মধ্য দিয়ে বড় পর্যায়ে তার তার অভিষেক ঘটে। পরবর্তীতে তিনি বারিধারা ছেড়ে শেখ জামাল ধানমন্ডি ও ফর্টিস এফসিতে খেলেছেন। ঘরোয়া মৌসুমে সর্বশেষ তাকে ফর্টিসের জার্সিতে দেখা গিয়েছে। বর্তমানে তিনি ফর্টিসের পাট চুকিয়ে নতুন মৌসুমের জন্য শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের ডেরায় নিজের নাম লিখিয়েছেন।

বাংলাদেশের জার্সিতে মিতুলের প্রায় সব বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বয়সভিত্তিক দলে মিতুলের পদযাত্রার শুরুটা হয় অ-১৫ দলের হয়ে। তারপর তিনি অ-১৮, অ-১৯ খেলে বর্তমানে বাংলাদেশ অ-২৩ দলের হয়ে খেলছেন। এই দীর্ঘ সময়পথে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থেকেছেন মিতুল। তিনি বলেন, “যখন আমি ঢাকা আসি, তখন থেকে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। যতই বাধা বিপত্তি আসুক না কেনো পিছু না হাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একমাত্র লক্ষ্য ছিলো জাতীয় দলে খেলার।”

এবারের এশিয়ান গেমসে ফুটবলে দ্বিতীয় বারের মতো অংশ নেয় বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল। গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোর ক্লাব থেকে ছুটি না মেলায় সুযোগ আসে মিতুলের কাছে। সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন মিতুল। চীন, ভারত, মিয়ানমারের মতো দলগুলোকে সামলেছেন, “বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচ খেলা সবার জন্য স্পেশাল। আমাদের দেশের বর্তমান গোলরক্ষক জিকো ভাই অনেক ভালো করছেন। সাফে তিনি অসাধারণ খেলেছেন, উনার জন্য বাংলাদেশ আরো ভালো পারফরম্যান্স করতেছে। তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে আমাকে অবশ্যই ভালো পারফরম্যান্স করতে হবে। তাই যখন আমি দেশের হয়ে মাঠে নামবো, আমাকে ভালো করতেই হবে এইরকম একটা জেদ শুরু থেকেই ছিলো। সেই জেদটা বুকে নিয়ে আমি এশিয়ান গেমসের প্রতিটা ম্যাচে মাঠে নেমেছি।”

দুর্ভাগ্য যদি বাংলাদেশের সঙ্গী না হতো তাহলে মিতুলের নৈপুণ্যতায় ভর করে বাংলাদেশ হয়তো পরবর্তী রাউন্ডে কোয়ালিফাই করে ফেলতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কারণে তা আর হয়ে উঠে নি। তবে আনিসুর রহমান জিকোর পর নতুন আরেক বাজপাখির সন্ধান পেতে চলেছে বাংলাদেশ তা অনুমান করাই যায়।

আগামী মালদ্বীপ সিরিজে বাংলাদেশ দলে ডাক পেয়েছে মিতুল মারমা। অনুমান করা যাচ্ছে মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক করতে যাচ্ছেন মিতুল।

Previous articleবাফুফের স্থায়ী সাধারণ সম্পাদক হলেন ইমরান হোসেন তুষার!
Next articleপরপারে পাড়ি জমালেন সাবেক ফিফা রেফারী!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here