‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের গানের লাইনগুলোর মতো করে ফিরে এসে দেশের ঘরোয়া ফুটবলের দুই ক্লাব। অবশ্য এখন তাদের দেশের প্রথম সারি দুই ক্লাব। কারণ ক্লাব দুইটি আগামী মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ আসর বিপিএলে খেলবে। ক্লাব দুইটি হলো ফকিরেরপুল ইয়াং ম্যানস ক্লাব এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। নিজেদের কলংকের পূর্ব কীর্তিকলাপকে পেছনে ফেলে এই দুই ক্লাবে এখন বয়ে চলছে বিপিএল খেলার আনন্দ।

২০১৯ সালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দেশের ক্লাবগুলোতে বড় রকমের অভিযান চালায়। তাদের এই অভিজানে ছয় ক্লাবের ভাগ্যে জুটে নির্মম এক বাস্তবতা। ক্লাবের সদর দরজায় তালা পড়ে, তবেও দমে যায় নি ক্লাবগুলো। এপাশ-ওপাশ করে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়েছে তারা। গতবছরে ক্লাবগুলো নানান শর্তসাপেক্ষে নিজেদের ক্লাব হাইজ খোলার অনুমতি পেয়েছে। তবে যা সর্বনাশ হওয়ার এই চারবছরের মধ্যে হয়েছে। তস্করের বিশেষ জাদুকরী প্রতিভায় ক্লাবগুলো হারিয়েছে তাদের অর্জিত ট্রফি।

এতোকিছু হারানোর পরেও লড়াই করতে ভুলে নি তারা। নতুন কমিটির যোগ্য নেতৃত্বে এগিয়েছে ক্লাবগুলো তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং ফকিরেরপুল ইয়াং ম্যানস। যারা বর্তমানে বিসিএল থেকে বিপিএলে উত্তীর্ণ হয়েছে। একসময়ের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সফল ক্লাব ছিলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। দেশের টপ টায়ারে অবাদ বিচরণ ছিলো তাদের, ট্রফি জয়ের পাশাপাশি দাপটও ছিলো দারুণ। কিন্তু আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে থাকে ক্লাবটি,যার যবনিকা পতন ঘটে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৫ সালে প্রিমিয়ার লীগ থেকে অবনমন ঘটে দলটির। ২০০৩ সালেও আবারো প্রিমিয়ার খেলার যোগ্যতা করে দলটি। কিন্তু সেই যোগ্যতা বেশীদিন ধরে রাখতে পারে নি।মাত্র তিন মৌসুম পরে প্রিমিয়ার আবারো বিদায় ঘটে তাদের।

ক্যাসিনো কান্ডের পর যখন ক্লাব হাউজের তালা খোলা হয় তখন প্রায় শূন্য অবস্থায় ক্লাবকে পেয়েছিলো ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা। ট্রফির পাশাপাশি ক্লাব বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসও খুইয়েছে তারা। ক্যাসিনো কান্ডের পর নতুন কমিটির দেখা পেয়েছিলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। তাদের কঠোর পরিশ্রমে আজ আবারো হারানো সাফল্য ফিরে পেতে যাচ্ছে দলটি।

তবে ক্লাব কার্যক্রম চালিয়ে মোটেও সহজ ছিলো না বলে জানিয়েছেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন। অর্থের যোগান পেতে অনেকের কাছে যেতে হয়েছে, তবে নিজেদের সততার পরিচয় দিয়েও অনেকের সকলের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারতো না,

‘এতদিন লোকজনের কাছে রীতিমতো ভিক্ষা নিয়ে ক্লাব চালাতে হয়েছে। কেউ সহজে টাকা দিতে চাইতো না। তাদেরকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি ক্লাবে আর ক্যাসিনো চর্চা নেই। জুয়া বা অন্য কোনও নিষিদ্ধ কার্যক্রমও চলে না। তারপরও সবাই দিতে চায়নি। নিজেরা সবাই মিলে অনেক কষ্টে অর্থ সংগ্রহ করে ক্লাব চলছে। সবার চেষ্টায় ফুটবলে এবার কিছুটা সাফল্য এসেছে।’

দীর্ঘ ১৮ বছর পর বিপিএলে ফিরতে চলেছে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। দল নিয়ে এখন বেশ আশাবাদী কামাল হোসেন। তিনি বলেন,

‘এখন নতুন করে আবার ফিরতে পেরে দারুণ লাগছে। আমাদের সভাপতি কাজী শহিদল্লাহ লিটনের ইচ্ছা ছিল দলটাকে পেশাদার লিগে আনতে। আমরা তাতে সফল হয়েছি। আশা করছি সামনের মৌসুমে আমরা মূল স্তরে খেলবো। এখন আমাদের ক্লাবে কোনও নেতিবাচক কিছু হয় না। সবাই সতর্ক আছে।’

দলের কোচ আবু ইউসুফও নিজের লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেছেন। নিজের কাজে তিনি ক্লাবের কারো কাছ থেকে বাধা পাননি বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন,

‘মাঠে খেলার পাশাপাশি পর্দার আড়ালের দলের সঙ্গেও লড়তে হয়। ফুটবলের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনেও কিছুর সঙ্গে আমাকে আপস করানো যাবে না। আমি করিনি। তাই এত দূর আসতে পেরেছি। এছাড়া ক্লাবের সবাই আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। আমি ঠিকমতো কাজ করতে পেরে খুশি।’

 

আরেক ক্লাব ফকিরেরপুল ইয়াং ম্যানস ক্লাবের ঐতিহ্যও কম। লাল-সবুজের জার্সির অনেক খেলোয়াড়ই উঠে এসেছে ইয়াং ম্যানস ক্লাবের হাত ধরে। যার সোহেল আল মাসুম, আসকর বাবু ও আমিন রানা অন্যতম। তবে এই ঐতিব্যবাহী ক্লাবকে ধারদেনা করতে চলতে হয়েছে। ক্লাবে তালা পড়ার পর অনেক কষ্ট করে ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মাইনুর বলেন,

‘তিন বছর আগে আমরা ক্লাবে দায়িত্ব নিয়েছি।  আমরা ধার-দেনা করেছি বন্ধু-বান্ধুবসহ সব জায়গায়। নিজের ব্যবসা থেকেও। ক্লাবে তালা থাকায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসে কাজ করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে দল চালাতে হয়েছে। ক্লাবে বসতে পারিনি। তারপরও আমরা হতোদ্যম হইনি। জানি একদিন আলো আসবেই। আজ ফুটবলে সাফল্য পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। এছাড়া কিছু বিগদগামী কর্মকর্তাদের কারণে ক্লাবটির বদনাম হয়েছে। তা ঘুঁচিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে।’

আগামী মৌসুমে ক্লাবটি বিপিএল খেলতে যাচ্ছে। বিপিএল খেলতে প্রয়োজন অনেক টাকার, তবে এক্ষেত্রে ক্লাবের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের উপর ভরসা করছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন,

‘এখন প্রিমিয়ার লিগে খেলবো। অন্তত এক মৌসুম খেলবো। এখন ওখানে খেলতে অনেক টাকা লাগবে। আমাদের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মাখন ভরসা দিয়েছেন। সবাই মিলে দৌড় ঝাঁপ করলে ভালো কিছুই হবে।’

ফকিরেরপুলের চ্যাম্পিয়নের পিছনে অন্যতম কারিগর রাফায়েল টুডো। গোলরক্ষক থেকে স্ট্রাইকার হাওয়া এই সাওতাল বালকের নৈপুণ্য একেরপর এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয় পেয়েছে ফকিরেরপুল। নিজের ক্লাবের সাফল্যে তাই টুডু বেশ আনন্দিত। ক্লাব কর্তৃপক্ষের গুণগান গাইতেও ভুলেন নি টুডু। টুডু বলেন,

‘এখানে আমরা নির্দ্বিধায় খেলেছি। পারিশ্রমিক বা থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। এই ক্লাবটির ঐতিহ্য আছে শুনেছি। আশা করছি সামনে আরও এগিয়ে যাবে।।’

আগামী মৌসুমে দুই ক্লাবই বিপিএল খেলতে চায়। ফিরে পেতে চায় নিজেদের ঐতিহ্য। সেই পথে কতটুকু সফল হবে তা এখন শুধু ভবিষ্যতের সময়ই বলে দিবে।

Previous articleদুই শত ফুটবলার নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো বাফুফের ন্যাশনাল ট্রায়াল
Next articleদেশের লাইভ ফুটবল (শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here