কথায় আছে টাকায় নাকি বাঘের দুধও মিলে। তবে যে ব্যক্তি এই প্রবাদ রচনা করেছিলেন তিনি যদি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দিকে তাকাতেন তাহলে হয়তো এই প্রবাদের অংশের দীর্ঘতা আরেকটু বৃদ্ধি করতেন। ‘টাকায় বাঘের দুধ মিললেও,জয় মেলে না।’ জয় যেনো বাংলাদেশ দলের কাছে অমাবশ্যার চাঁদ, চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও তার দেখা মেলা ভার।

ম্যাচের আগে খেলোয়াড় ও কোচের মুখে কথার ফুলঝুরি। কিন্তু ম্যাচের পর তাদের মুখই হয়ে যায় চুপসে যাওয়া বেলুন। ম্যাচের আগের জয় পাওয়ার কথা বললেও, মাঠে চরম হতাশাজনক পারফরম্যান্স গড়ে তুলে জয়-পরাজয়ের বিশাল ফারাক। শেষ দশ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় মাত্র দুইটিতে, বাকি আট ম্যাচে হয় হার নাহয় ড্র। হার বা ড্র এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা দুইটি কারণ খুব মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তার মধ্যে একটি হলো ফিনিশিং ব্যর্থতা আর অন্যটি হলো শেষ মুহুর্তে রক্ষণের খেই হারানো।

বাংলাদেশ দলের ক্ষেত্রে ফিনিশিং ব্যর্থতা আর রক্ষণে খেই হারানো চিরায়ত অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ দলের ম্যাচের মূল আকর্ষণ হয় ফিনিশিং ভরাডুবি নাহয় রক্ষণের ছন্নছাড়া রূপ। গত ম্যাচের কথাই নাহয় ধরা যাক। পুরো মাঠে বাংলাদেশ দল পাসিং ফুটবল খেললেও ডি বক্সের সামনে আসলেই বাংলাদেশ দল হয়ে যায় শাওলিন সকার ফুটবল টিম। তবে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ছবিতে শাওলিন সকারের লং রেঞ্জের শট গোলের দেখা পেলেও বাংলাদেশ দলের একেকটা শট হয় বারপোস্টের অনেক উপর দিয়ে গ্যালারিতে ল্যান্ডিং করে, আর নাহয় প্রতিপক্ষের রক্ষণের বাধাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসে। ফলাফল দিনশেষে একেকটা ব্যার্থতার গল্প রচনা করে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মাঠে নামার প্রত্যয়। আর এটাই হয়ে উঠেছে বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দৈনন্দিন চিত্র।

কিন্তু ফুটবলে একটি দিক দিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ! পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল বলুন, কিংবা চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি-ইতালি। ফ্রান্স, আর্জেন্টিনাকেও বিপুল ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এমন তারকাখচিত ফুটবল ফেডারেশন আর আছে নাকি কোথাও! বাংলাদেশে ফুটবল খেলাটা চালানই দেশের ইতিহাসের সেরা ফুটবল তারকা। তাঁর সহযোগী হিসেবে অনেকেই আছেন, যাঁরা দেশের জার্সি গায়ে খেলেছেন, খেলোয়াড়ি জীবনে একেক জন ছিলেন বড় তারকা। কিন্তু এত কিছুর পরেও ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৬। ২০৬ টি দেশের মধ্যে এই র‌্যাঙ্কিং ১৯৭-এ নেমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। বড় বড় তারকারা ছিলেন বলেই রক্ষা! তাঁরা টেনে-হিঁচড়ে কোনোমতে ১৮৬-তে রেখেছেন দলকে। এটাও কি তাদের জন্য গর্বের বিষয় নয়? তাদের ভাবভঙ্গি দেখে অন্তত সেটাই মনে হয়। সাফল্য ব্যার্থতা ছাপিয়ে ফুটবল মাঠে রাখাতেই যাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে তাদের কাছ অবশ্য এর চাইতে বেশি কিছু আশা করাও বোকামি। দিনশেষে তো তাদের চেয়ার তাদের কাছেই থাকে আর হতাশ হয় সারাদেশের কোটি ফুটবল প্রেমী।

কিন্তু দেশের ফুটবলে এত সাবেক তারকার সমাবেশ, সে দেশের ফুটবলের অবস্থা এমন কেন! খেলোয়াড়ি জীবনে এই মানুষগুলোই তো ফেডারেশন তাঁদের এই দিচ্ছে না, সেই দিচ্ছে না বলে আকাশ-বাতাস গরম করে তুলতেন। কিন্তু নিজেরা ফুটবলের নেতৃত্বে এসে দেখালেন যে লাউ সেই কদু!

২০০৮ সালে বিপুলসংখ্যক সাবেক তারকা ফুটবলাররা যখন ফেডারেশনের নেতৃত্বে এলেন, তখন মনে করা হয়েছিল অনেক দিন ধরে চলে আসা ওই নেতিবাচক ব্যাপারগুলোর চিরদিনের জন্য দূরে সরে যাবে ফুটবল থেকে। ফুটবল নিয়েই কাজ হবে, দীর্ঘ দিনের অপ্রাপ্তিগুলো ঘুচবে, ফুটবল সাজবে নতুন রঙে। কিন্তু সে সবের প্রায় কিছুই হয়নি। সেই টেবিল গেম, কাদা ছোড়াছুড়ি, অ-ফুটবলীয় সংস্কৃতি চলছে। বাংলাদেশের ফুটবলের নেতৃত্বে থাকা সাবেক তারকা ফুটবলাররা এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেই পারেন। তাঁরা দীর্ঘদিনের চালু সংস্কৃতিটাই ধরে রেখেছেন, ঐতিহ্য রক্ষায় তাদের অবদান, অবস্থান বিশ্বে অতুলনীয়। একই গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে খুবই পছন্দ করেন বাংলাদেশের ফুটবল সংগঠকেরা। বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র দেশ, যেখানে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই সংগঠকদের ফুটবল পরিচালনায়। এ দিক দিয়ে তাঁরা একটা স্বাতন্ত্র্যভাব বজায় রাখার রেকর্ডই গড়ে ফেলেছেন তারা। সারা দুনিয়ার ফুটবল যেভাবে চলে, এখানে চলে অন্যভাবে। সারা দুনিয়াতে ফুটবল ক্লাব আছে, যাঁরা নিজেদের একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, আর এখানে খেলার সংস্কৃতিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।

স্বাধীনতার পর দুই-একজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুষ্টিমেয়, মুখচেনা ফুটবল সংগঠকেরাই বাংলাদেশের ফুটবল চালিয়েছেন। মানুষের জীবনের নিয়মে তাদের ওই দলে শূন্যস্থান এসেছে, সেই শূন্যস্থান ভরাট করেছে নতুন কেউ, কিন্তু ফুটবলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই সংগঠকেরা কিংবা তাদের সুগ্রীব-দোসররাই যখন ফুটবল বদলে দেওয়ার ইশতেহার দেন, সেই ক্লাব-সংস্কৃতি পরিবর্তন, ফুটবল বিপণন সঠিকভাবে করা ইত্যাদি কথা আওড়ান—তখন তা কেবল ফাঁকা বুলি বলেই মনে হয়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দেশের ফুটবলপ্রেমীরা তখন অন্য দেশের লিগ ম্যাচ দেখতে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। দেশের ফুটবল নিয়ে ভাবনাটা তখন তাঁদের কাছে মনে হয়, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা!

দিনশেষে জাতীয় দলের খেলা দেখতে এসে একেকটা হতাশা সঙ্গী করে মাঠ ছাড়েন দর্শকরা। আর নতুন করে দেশের ফুটবলের উন্নতির প্রত্যাশায় সংবাদ সম্মেলনে সেই দর্শকদের মনে আশার সঞ্চার করে ফেডারেশন কর্তারা। কিন্তু পরবর্তী ম্যাচেও আবার সেই ব্যার্থতা আবারো আশার বাণী। আর একারণেই দিন দিন দেশের মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে দেশের ফুটবল থেকে। কিন্তু প্রকৃত ফুটবল প্রেমীরা তো আর আশা হারা হন না! দেশের ফুটবলকে মন থেকে ভালোবাসা মানুষগুলোর জন্যই যেনো সবার মায়া জন্মায়। বেদনা-বিধুর এই সম্পর্ককে সঙ্গে নিয়ে আর কত স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী হবেন তারা?

Previous articleফরোয়ার্ডদের পারফরম্যান্সে খুশি ক্যাবরেরা!
Next articleআবারো র‍্যাংকিংয়ে পেছলো বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here